হাওজা নিউজ এজেন্সি: বিশ্বজুড়ে অসংখ্য কর্মজীবী মা এমন পেশায় কাজ করেন যেখানে দূর থেকে কাজের (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) সুযোগ নেই। পেশাগত দায়িত্ব, সময়সীমা এবং পারিবারিক কর্তব্য—এই তিনের ভারসাম্য রক্ষা অনেক সময় তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয় দাদা-দাদি, নানা-নানি বা অন্য আত্মীয়দের।
এই পরিস্থিতি শুধু মানসিক চাপ বা অপরাধবোধ তৈরি করে না, বরং ভিন্ন ভিন্ন শিশুপালন পদ্ধতির ধরণ শিশুর মানসিক বিকাশেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই কর্মজীবী মায়েদের সহায়তায় কর্মক্ষেত্রে নমনীয়তা, সামাজিক সমর্থন এবং পারিবারিক সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মনোবিজ্ঞানী ও পরামর্শক নাজমা খেইরানদিশ কর্মজীবী মায়েদের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত নির্দেশনা দিয়েছেন।
সন্তানকে অন্যের কাছে রেখে কাজ—অপরাধবোধ কমাতে করণীয়
এই উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক। তবে কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করলে তা সামাল দেওয়া সম্ভব।
১. নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। সন্তানকে বিশ্বস্ত পরিবারের সদস্যদের কাছে রেখে যাওয়া অবহেলা নয়; এটি দায়িত্ব ভাগাভাগি ও পারস্পরিক সহায়তার প্রতীক। দাদা-দাদি বা নানা-নানি সাধারণত ভালোবাসা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিশুর যত্ন নেন, যা তার আবেগীয় বিকাশে সহায়ক।
২. সময়ের পরিমাণ নয়, গুণগত মান গুরুত্বপূর্ণ।অফিস শেষে অল্প সময় পেলেও তা পুরো মনোযোগ দিয়ে শিশুর সঙ্গে কাটান। গল্প শোনা, খেলা, বা আন্তরিক কথোপকথন—এগুলো গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
৩. তত্ত্বাবধায়কদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। শিশুর খাওয়া, ঘুম, সময়সূচি ও মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করুন। এতে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে যত্ন আপনার নীতিমালা অনুযায়ী হচ্ছে।
৪. দিনের মাঝে ছোট যোগাযোগ রাখুন। কর্মদিবসের মাঝখানে সংক্ষিপ্ত ফোন বা ভিডিও কল শিশুকে আশ্বস্ত করবে এবং আপনাকেও মানসিকভাবে স্বস্তি দেবে।
৫. ইতিবাচক দিকগুলো দেখুন। দাদা-দাদি বা নানা-নানির কাছ থেকে শিশু নতুন গল্প, অভিজ্ঞতা ও সামাজিক দক্ষতা শিখে—যা তার মানসিক বিকাশে মূল্যবান অবদান রাখে।
৬. নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। ইতিবাচক আত্মকথন যেমন “আমি পরিবারের জন্য পরিশ্রম করছি এবং একই সঙ্গে একজন যত্নশীল মা”—এই ভাবনা অপরাধবোধ কমায়। একই অভিজ্ঞতার অন্যান্য মায়েদের সঙ্গে কথা বলাও সহায়ক।
৭. শিশুর আনন্দ ও নিরাপত্তাই আসল সূচক। যদি শিশু সুখী থাকে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তত্ত্বাবধায়কদের কাছে যায় ও ফিরে এসে স্বাভাবিক আচরণ করে, তাহলে বোঝা যায় সে ভালো আছে। অর্থাৎ ‘অবহেলা’ মূলত মায়ের মনেই তৈরি হয়, বাস্তবে নয়।
প্রজন্মভেদে পার্থক্য ও পারিবারিক সমন্বয়
দাদা-দাদি বা নানা-নানি প্রায়ই পুরোনো অভ্যাস ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিশুর যত্ন নেন। কখনো তা আধুনিক অভিভাবকত্বের ধারা থেকে আলাদা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা বজায় রেখে কিছু মৌলিক নীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করাই সেরা উপায়। খাদ্যাভ্যাস, স্ক্রিন টাইম, ঘুমের সময় ও নিরাপত্তার মতো মূল বিষয়গুলিতে সমন্বয় রাখুন, কিন্তু ছোটখাটো পার্থক্যে অতিরিক্ত কঠোর হবেন না।
ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর বিভ্রান্তি কমাতে করণীয়
দুই পরিবেশে কিছু নিয়মের পার্থক্য থাকলেও মূল মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা এক রাখুন। শিশুকে বোঝান—“প্রতিটি ঘরের কিছু নিয়ম আলাদা হতে পারে, কিন্তু শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা ও ভালো আচরণ—সব জায়গায় একই।” এভাবে শিশু শেখে যে বৈচিত্র্যের মধ্যেও মূল্যবোধের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
নিয়ম ও সীমারেখা নির্ধারণে কার্যকর পদ্ধতি
মা ও দাদা-দাদি/নানা-নানির মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত, লিখিত নিয়মাবলি নির্ধারণ করুন—যেখানে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার মৌলিক বিষয়গুলো স্পষ্ট থাকবে। যেমন: টেলিভিশন দেখার সময়, খাবারের ধরন বা ঘুমের সময়সূচি। আলোচনা শুরুর সময় ইতিবাচক ও সম্মানসূচক ভাষা ব্যবহার করুন—“আপনাদের যত্ন ও ভালোবাসার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, সমন্বয় আরও ভালো করতে কিছু বিষয় একসঙ্গে ঠিক করে নিই।” এতে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয় এবং বিরোধ এড়ানো যায়।
দীর্ঘ ছুটির পর শিশুকে আবার নিজ বাড়ির নিয়মে ফিরিয়ে আনার উপায়
শিশু দীর্ঘ সময় আত্মীয়দের সঙ্গে কাটালে, তাকে ধীরে ধীরে এবং সহানুভূতিশীলভাবে আগের রুটিনে ফিরিয়ে আনুন। একসঙ্গে আলোচনা করে বলুন—“এখন আমরা ঘরে ফিরেছি, তাই আগের মতো নিয়মে ফিরব।” দাদা-দাদির বাড়িতে করা কিছু প্রিয় কাজ বা খাবার মাঝে মাঝে বাড়িতেও অন্তর্ভুক্ত করলে শিশুর মানসিক স্থিতি বজায় থাকে। সবচেয়ে জরুরি হলো অভিভাবকের শান্ত ও পূর্বানুমানযোগ্য আচরণ—যা শিশুকে নিরাপত্তা ও স্থিতি দেয়।
আপনার কমেন্ট